ইসলামিক কর্ণারশিক্ষা

পশু ও মৎস্য সম্পদের যাকাত: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

পশু ও মৎস সম্পদের যাকাত

আল্লাহ তা’লা মানব জাতির কল্যাণে পশুম্পদ সৃষ্টি করে দিয়ে এগুলো তাদের অনুগত করে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে পশুর বিবিধ কল্যাণের কথা স্পষ্ট করে ঘোষণা করা হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে পশু ও মৎস্য সম্পদের যাকাত এর বিধান আলোচনা করা হয়েছে।

পশু সম্পদের যাকাতের বিধান:

যাকাতযোগ্য সম্পদের মধ্যে পশু সম্পদ অন্যতম। পশুর শ্রেণী, পালনের ধরণ, মালিকানার, পশুর বয়স ও সংখ্যা অনুযায়ী যাকাত নির্ধারিত হয়। তবে সকল পশুর যাকাত দিতে হয় না। শুধু উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদির উপর যাকাত ওয়াজিব হয়। এগুলো ছাড়া অন্য কোন জন্তুর ক্ষেত্রে যাকাত ওয়াজিব নয়। যেমন- গাধা, খচ্চর, হাঁস-মুরগী ইত্যাদি।

পশু সম্পদের উপর যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্ত সমূহ:

পশু সম্পদের ক্ষেত্রে যাকাত ফরজ হওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত শর্ত গুলো প্রযোজ্য হবে।
১. বিচরণশীল (سائمة) হওয়া: যে সকল পশুর ক্ষেত্রে যাকাত দিতে হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে এই শর্তগুলো পাওয়া না গেলে যাকাত ওয়াজিব হবে না। অর্থাৎ- পশুটি যদি বিচরণশীল ( سائمة) হয় তবে যাকাত আবশ্যক হবে। অন্যথায় আবশ্যক হবে না। সায়েমা (سائمة) বলা হয় , ঐ সকল পশুকে যা বছরের অধিকাংশ সময় নিজে নিজেই মাঠে ঘাটে বিচরণ করে জীবিকা গ্রহণ করে এবং বংশ বৃদ্ধি করে। এই জন্য গৃহপালিত (علوفة) পশুর উপর যাকাত ওয়াজিব নয়।
২. বাহন বা চাষাবাদের জন্য না হওয়া:
পশুর ক্ষেত্রে যাকাত আবশ্যক হওয়ার আরেকটি শর্ত হল পশুটি বাহন বা চাষাবাদের জন্য পালিত না হওয়া। এমনকি যদি যুদ্ধের জন্য পালিত হলেও যাকাত ওয়াজিব হবে না। এ ক্ষেত্রে পশুটি সায়েমা(سائمة) হলেও যাকাত ওয়াজিব হবে না।
৩. নিসাব পরিমাণ হওয়া:
পশুর যাকাত ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি শর্ত হল পূর্ণ নিসাব পরিমাণ হওয়া। নিসাবের চেয়ে একটি কম হলেও যাকাত ওয়াজিব হবে না। যেমন- একজন লোকের ২ টি উট, ১০ টি গরু, ৩০ টি ছাগল আছে তাহলে তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। তবে এগুলো ব্যবসায়িক হলে তার মূল্যের উপর যাকাত দেয়া আবশ্যক।
৪. পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া:
উপর্যুক্ত শর্তাবলী সাপেক্ষে পশুর নিসাবের উপর পূর্ণ এক বৎসর অতিবাহিত হলেই কেবল যাকাত ওয়াজিব হবে। এ ক্ষেত্রে বছরের শুরু এবং শেষে নিসাব পরিমাণ থাকলেই যাকাত দিতে হবে। বছরের মাঝখানে কিছু কমে গেলে সেটা ধর্তব্য নয়।

ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পালিত পশুর যাকাত:

এ ধরণের পশুর দুটি অবস্থা হতে পারে।
প্রথম প্রকার: যদি স্বয়ং পশু গুলো ব্যবসায়িক পণ্য হয়। আর্থাৎ মোটা তাজা করে বিক্রির উদ্দেশ্যে পালিত হয়, তাহলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে। এ ক্ষেত্রে পশু , বাছুর, দুগ্ধ, গোশত, চামড়া,গোবর, সবকিছুই ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে গণ্য হবে। এবং বছর শেষে নিসাব পরিমাণ হলে ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।
দ্বিতীয় প্রকার: এ প্রকার হল পশুটি ব্যবসায়িক পণ্য নয় বরং তার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য যেমন-দুগ্ধ, মাখন, বাছুর , দুগ্ধজাত পণ্য ইত্যাদি উৎপাদন করার উদ্দেশ্যে পালন করা হয়ে থাকে । এ ক্ষেত্রে স্বয়ং পশুর উপর যাকাত আবশ্যক হবে না ; বরং তার থেকে উৎপাদিত পণ্যের উপর যাকাত ওয়াজিব হবে। কারণ বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুতকৃত দ্রব্যের উপর যাকাত ওয়াজিব হয়।

ডেইরি ও পোল্ট্রি ফার্মের যাকাত:

ডেইরি ফার্মের পশু যদি শুধুমাত্র দুগ্ধ বা দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য কিংব বাছুর উৎপাদনের জন্য পালন করা হয় তাহলে এসব পশু পণ্য উৎপাদকের পর্যায়ভুক্ত । তাই এগুলোর উপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। বরং তার থেকে উৎপাদিত পণ্যের উপর যাকাত ওয়াজিব হবে। কারণ যাকাত ওয়াজিব হয় উৎপাদিত পণ্যের উপর (عروض التجارة) । অনুরূপ পোল্ট্র্রি ফার্মের হাঁস-মুরগীর ক্ষেত্রেও একই হুকুম ।

সায়েমা পশুর সাথে ব্যবসার যাকাত একত্রিত হলে:

যদি কারো নিকট নিসাব পরিমাণ সায়েমা পশু থাকে এবং এগুলোর দ্বারা ব্যবসার নিয়ত করে থাকে তাহলে তার উপর সায়েমা পশুর যাকাত এবং ব্যবসার যাকাত উভয়টি ওয়াজিব না হওয়ার বিষয়ে সকর ইমামগণ একমত। কেননা এ বিষয়ে আল্লাহর নবী সা. এর বাণী হল , لا ثني في الصدقة অর্থাৎ- যাকাতের মধ্যে পুনরাবৃত্তি নাই। তবে উভয়ের মধ্যে কোন্ প্রকার যাকাত ওয়াজিব হবে, সায়েমার নাকি ব্যাবসার যাকাত ওয়াজিব সে বিষয়ে ইমামগণের মাঝে মতভেদ আছে।
ফিকহে হানাফী ও হাম্বলী:
ইমাম আবু হানিফা রহ.ও তাঁর অনুসারী এবং ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ. এর মতে, এই দুই প্রকার যাকাতের মধ্যে এক্ষেত্রে ব্যবসার যাকাত ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ- পশুর সংখ্যা নিসাবের চেয়ে কম হলেও তার মূল্য যদি স্বর্ণ/ রৌপ্যের নিসাবের সমপরিমাণ হয় তাহলে তাতে ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে। কেননা এটাই গরীবদের জন্য উপকারী।
ফিকহে শাফেয়ী ও মালেকী:
ইমাম মালেক রহ. এবং ইমাম শাফেয়ীর নতুন মাযহাব অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে মৌলিক যাকাত ওয়াজিব হবে। আর তা হল সায়েমা পশুর যাকাত অর্থাৎ সায়েমা পশুর সংখ্যা যদি নিসাব পরিমাণ হয় তবেই যাকাত ওয়াজিব হবে। এ ক্ষেত্রে মূল্য ধরে ব্যবসার যাকাত ওয়াজিব হবে না ।

মৎস সম্পদের যাকাতের বিধান:

সাধারণত মাছের কোন যাকাত নেই। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষকৃত মাছের যাকাত দিতে হবে। কারণ তখন তা ব্যবসায়িাক পণ্যের (عروض التجارة) অন্তর্ভূক্ত হবে। আর ব্যবসায়িক পণ্যের উপর যাকাত দেয়া ওয়াজিব। সাধারণত অতীতকালে পুকুর, নদী, জলাশয়, খাল ইত্যাদিতে মাছ চাষ করা হত; কিন্তু বর্তমানে ব্যপকহারে হাজার হাজার একর কৃষি জমিতে মাছ চাষ করা হয়। বিশেষ করে ’চিংড়ি চাষ’ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
সুতরাং, মাছ চাষীকে কোন প্রকার যাকাত দিতে হবে-কৃষি জমিতে চাষের কারণে উশর দিতে হবে নাকি ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে ব্যবসার যাকাত দিতে তা আলোচনার বিষয়।
এ ক্ষেত্রে যদি মাছ চাষ কৃষি জমিতে না হয়ে পুকুর কিংবা নদী, খাল ইত্যাদিতে হয়ে থাকে এবং তাতে ব্যবসার নিয়ত থাকে তবে সর্বসম্মতিক্রমে তাতে উশর নয় বরং ব্যবসার যাকাত দিতে হবে। কিন্তু যদি মাছ চাষ করা হয় কৃষি জমিতে যেমন বর্তমানে চিংড়ি চাষ তাহলে তাতে কোন প্রকার যাকাত ওয়াজিব হবে তা নিয়ে মতভেদ আছে।
অধিকাংশ আলেমের মতে, উভয় প্রকার যাকাত একসাথে ওয়াজিব হবে না। অর্থাৎ- কৃষি জমিতে চাষের কারণে একবার উশর এবং ব্যবসার নিয়ত থাকার কারণে আরেকবার ব্যবসার যাকাত দিতে হবে না। কারণ একই দ্রব্যে আল্লাহর দুটি হক একত্রিত হয় না। বরং উভয় প্রকার যাকাতের যেকোন একটি যাকাত ওয়াজিব হবে।
কিন্তু এতদুভয়ের মধ্যে কোনটি ওয়াজিব তা নিয়ে মতভেদ আছে-
ফিকহে হানাফী:
ইমাম আবু হানিফা রহ. সহ অধিকংশ আলেমের মতে উভয়ের মধ্য থেকে ব্যবসার যাকাত নয় বরং উশর ই ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ- প্রত্যেক মৌসুমে তার ৫% বা ১০% যাকাত দিতে হবে। কারণ এতেই গরীবের অধিক উপকার নিহিত।
ফিকহে শাফেয়ী ও মালেকী:
ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম মালেক রহ. এর মত হল, এরূপ ক্ষেত্রে উশর নয় ; বরং ব্যবসার যাকাত যাকাত ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ এর মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয় এবং তাতে এক বছর অতিক্রম করে তাহলে ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।
ফিকহে হাম্বলী:
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এবং আবু সওর রহ. বলেন, এ ক্ষেত্রে উভয় প্রকার যাকাত ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ কৃষি জমিতে হওয়া কারণে একবার উশর এবং ব্যবসার নিয়ত থাকার কারণে আরেকবার ব্যবসার যাকাত দিতে হবে। আর এখানে لا يجتمع حقان لله في مال واحد বক্তটির বিপক্ষেও যায় নি। কেননা এখানে দুটি হক একত্রিত হয় নি। বরং এখানে যাকাত ওয়াজিব হবে মূল্যের উপর পক্ষান্তরে উশর ওয়াজিব হবে উৎপন্ন পণ্যের উপর।
তবে গ্রহণযোগ্য মত হল আহনাফের মত । অর্থাৎ- একই দ্রব্যে আল্লাহর দুটি হক একসাথে একত্রিত হয় না। এবং উভয়ের মধ্যে উশর ওয়াজিব হবে । কারণ এটাতেই গরীবদে বেশি উপকারী। আর যাকাত প্রদানের অন্যতম উদ্দেশ্যই হল দারিদ্র বিমোচন। এবং এটাই অধিক সতর্কতার বিষয়।
পরিশেষে বলা যায়, ইসলামের অন্যতম বিধান যাকাত এবং উশর দুটি শুধুমাত্র ফরজ ইবাদত ই নয় ; বরং একটি সমাজের অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল হাতিয়ার। যার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছেল ইসলামের সেই সোনালি যুগে। তাই এগুলোর বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের দেশকেও উন্নত করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রক্রিয়ায় যাকাত প্রদান। যাদের যাকাত প্রদান করা যাবে না তাদের পরিবর্তে যাদের প্রয়োজন তাদেরকেই দেয়া।
এই বিষয়ে আরো জানুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button